প্যারাসাইট : মার্ক্সবাদের ভিজুয়াল পাঠ



কার্ল মার্ক্স ছিলেন শিল্প বিপ্লবের যুগের মানুষ। তার আলোচনায় উপস্থিত ছিল শ্রমিকশ্রেণি আর তাদের শ্রমের ওপর আয়েশ করা ধনিকশ্রেণির বৈষম্য, সমাজচিত্র আর পুঁজিবাদের কদর্যরূপ। সেই আলাপগুলোও, স্বাভাবিকভাবেই ছিল কাগজে লেখা। সেই আলাপগুলোই কালের বিবর্তনে, কাগজ ছাপিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নানা মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের অসম সমাজের দুর্দান্ত বিবরণ হিসেবে।

মার্ক্সের সেই চিন্তা অবশ্য চিরন্তন হয়ে উঠেছে দেখার আর বিশ্লেষণের দৃষ্টি এবং চিন্তার প্রসার ঘটাতে পারার কারণে। এখনো চিন্তকরা মানুষের অসাম্যের সমাজ নিয়ে বিশ্লেষণ করেন, এর গতিধারা বোঝার চেষ্টা করেন। সেই আলাপ যে শুধু মার্ক্সের কালের মতো কাগজে-কলমেই হয় তা না, সেটা হতে পারে সেলুলয়েডের ফিতাতেও। যেমনটা করেছেন, কোরিয়ান চলচ্চিত্রকার বং জুন হো। আর ব্যাপারটা কেবল চিন্তা নয়, প্রকাশভঙ্গিটাও নান্দনিক, শৈল্পিক। সিনেমা আর্টের সমস্ত শক্তি আর ক্ষমতা দিয়ে তিনি রচনা করেছেন এক আধুনিক   মেনিফেস্টো, যার নাম প্যারাসাইট।

এবার সেরা চলচ্চিত্রের অস্কারপ্রাপ্ত সিনেমাটিকে শুরুতেই মার্ক্সের লেখার সঙ্গে তুলনা করার একটা বড় কারণ হচ্ছে, সেই ক্লিশে আলাপটা এড়ানো সিনেমা এমন এক শিল্প যার অসংখ্য লেয়ার থাকে, আর ভালো সিনেমার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে কেউ আলাদা করে লেয়ারগুলো না বুঝেই, প্রশান্তি নিতে পারেন। প্যারাসাইট নামক এই মাস্টারপিসকে যেমন গভীরভাবে একটি মার্ক্সবাদী বিবরণ হিসেবে ধরা যায়, আবার স্রেফ ঘণ্টা দুয়েকের এক রুদ্ধশ্বাস বিনোদন হিসেবেও নেওয়া যায় যাতে আছে টানটান উত্তেজনা, এক্সট্রিম লেভেলের ডার্ক হিউমার, অ্যাকশন একেবারেই আরাম কেদারায় বসে দারুণ একটা সময় কাটানোর সব অনুষঙ্গ। আগে দেখে না থাকলেও, অস্কার পাওয়ার পর এই সিনেমা মোটামুটি সব সিনেমাপ্রেমীকেরই দেখা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

 ফলে, কাহিনী বিবরণে যাওয়াটা আসলে পাঠকের জন্য একধরনের সময় নষ্ট। বরং এর যে নানামাত্রিক লেয়ার, প্রতিটি লেয়ারের সৌন্দর্য, বার্তা, একেকটা লেয়ার মিলিয়ে সামগ্রিক একটা সৌন্দর্য, সমাজচিত্র তুলে ধরার জন্য সিনেমাটিক এপারেটাসের পরিপূর্ণ ব্যবহার সেগুলো নিয়ে বরং কিছু আলোকপাত করা যাক।

ধনী গরিব বৈষম্য, তথা অর্থনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্য এই সিনেমার মূল থিম। মোট তিনটি পরিবারের কাহিনী নিয়ে এই সিনেমা আবর্তিত। এই পরিবারগুলোর অবস্থান বুঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হচ্ছে এদের বাসস্থান। সবচেয়ে উঁচুতলায় থাকা পরিবারটির বাড়ি যে কেবল খুবই দামি ও ঝকঝকে তাই কেবল নয়, এই বাড়িতে সবসময় সূর্যালোক পাওয়া যায়। মাঝারি পরিবারটির অবস্থান একটি সেমি বেইসমেন্টের মতো জায়গায়, যেটির অর্ধেক মাটির নিচে আর জানালার ওপরের কিছু অংশ মাটির ওপরে। এদের অবস্থান সবসময়েই খুব অস্থিতিশীল, এরা কখনো একটু উঁচুতে উঠে যায় (যখন পুরো পরিবারটি সাময়িক সময়ের জন্য ধনী বাড়িটি ভোগ করার সুযোগ পায়) আবার কখনো আরও তলিয়ে যায় (পানিতে বাড়িটির ভেসে যাওয়া কিংবা খুনের দায় নিয়ে পাতালঘরে চলে যাওয়া পিতা)। আর সবচেয়ে নিচুতলায় থাকা পরিবারটি, ধনী পরিবারের বাড়ির নিচে এক লুকানো পাতালঘরে থাকে। এরা কখনো আলোর দেখা পায় না, এরা ধনী পরিবারটির উচ্ছিষ্টের ওপর ভর করে টিকে থাকে। এই পরিবারের স্ত্রীটি সেই পাতালেই খুন হন আর স্বামীটি যাকে সত্যিকার অর্থেই প্যারাসাইট বলা যায় তিনি শেষমেশ খুনের নেশা নিয়ে কিলবিল করে বেড়ান, হত্যা করেন, করান এবং নিজেও খুন হন। অর্থাৎ, যে সূর্যের আলো পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর সমানভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেই জিনিসটিও এই বৈষম্যর সমাজে চরম অসাম্যের সঙ্গে বণ্টিত।
অনুরূপভাবে এই পৃথিবীও আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে হুমকির সম্মুখীন। সিনেমাতে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের দৃশ্যটি পর্যালোচনা করে দেখা যাক। সেদিন ধনী পরিবারটির একটি ক্যাম্পিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তবে হতচ্ছাড়া বৃষ্টির কারণে ওরা বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়। এতে বিরক্ত হলেও এরা ব্যাপারটি পুষিয়ে নেয় পরের দিন গার্ডেন পার্টির মাধ্যমে। অন্যদিকে, সেমি বেইসমেন্টে থাকা পরিবারটি এই অতিবৃষ্টিতে সর্বস্বান্ত হয়।   এদের ঘর আর জিনিসপত্র সব ভেসে যায়। একটা দৃশ্যে দেখা যায় যে, ওদের মতো আরও শয়ে শয়ে লোক সর্বহারা হয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে রাত কাটাতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ, যে পরিবেশ বিপর্যয় দরিদ্রের কাছে মারণঘাতী, সেটা ধনীর কাছে ‘সামান্য বিরক্তি’।   গাড়িতে পরদিন বৃষ্টি নিয়ে রসিকতা করা ধনী কর্ত্রী, যিনি হাসতে হাসতে বলেন যে, আমরা ক্যাম্পিংয়ের বদলে ঘরে পার্টি করব, আর সব হারানো দরিদ্র ড্রাইভারের যে দৃশ্য, সেটা অনবদ্য। জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে ধনী আর দরিদ্র শ্রেণির বিপদ আর মানসিকতা বোঝাতে সিনেমার এই অংশটা দুর্দান্ত। আশ্রয়কেন্দ্রে কাটানো অসহায় মানুষগুলোকে দেখে বাংলাদেশের মতো জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা মানুষ আর ধনী পরিবারটিকে মেটাফোরিকালি ধনী দেশের ধনিকশ্রেণির সঙ্গে মেলানো যেতে পারে।

মেটাফোরের কথা বলাতে একটু মন্তাজের কথা বলে নিই। এই সিনেমায় এই জিনিসের এত এত দারুণ ব্যবহার, যেন মনে হয় ওস্তাদ আল্লারাখা আর রবিশংকরের বাজনা শুনছি। নিখুঁত পরিকল্পনায় দরিদ্র পরিবারটির ধনী বাড়ির দীর্ঘদিনের গৃহপরিচারিকাকে উৎখাত করা আর সেখানে ওদের মাকে স্থলাভিষিক্ত করার পাঁচ মিনিটের সিকোয়েন্সটি ৩০টা সিনের এক অনবদ্য মন্তাজ। এই নিখুঁত মন্তাজ একেবারে শরীরের রোমকূপগুলো দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে হয়, নিখুঁত নোটে কোনো শিল্পী বেহালা বাজিয়ে গেলেন। লালমোহন গাঙ্গুলীর ভাষায় ভাবা যায় না মশাই! আরও কিছু সুন্দর মন্তাজের উদাহরণ হচ্ছে, বোনটি যখন প্রথমবার ঐ বাড়িতে যায় সে-সময়কার গানের সুরে সুরে কথা মনে রাখা, বাচ্চাটির তীর ছোড়া, বাচ্চাটির রেড ইন্ডিয়ানপ্রীতি।   এই বাচ্চাটি যেন আমেরিকা নামক ধনী রাষ্ট্রের আসল, নেইভ বাসিন্দা, যারা বাকিদের মতো প্রচন্ড ভোগবাদিতা, ভাবলেশহীনতা আর নিচুজাতকে ঘেন্নার চোখে দেখে না। এই ঘেন্নার ব্যাপারটা আসে গন্ধের মেটাফোরে। বারংবার এই জিনিস দেখা যায় গাড়িতে, ড্রইংরুমে কিংবা পার্টিতেও।

 গরিবরা যে আদতে ঊনমানুষ, দুর্গন্ধময় এই বিষয়টা ধনিকশ্রেণি ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দেয়। আর শেষতক এক দরিদ্র, সব সহ্যের বাঁধ ভেঙে, চরম অপমানিত হয়ে খুন করে বসে, যখন তার ধনী মালিক গন্ধে নাক চেপে বসে। সেইখানেও আরেক দুর্দান্ত মন্তাজ। মৃত প্যারাসাইটের রক্তের ওপর বসা মাছি। পরিচালক বং একলব্যর মতো তার গুরু টারান্টিনোকে এখানে এই দৃশ্যের মাধ্যমে সম্মান দেখান। সিনেমাপ্রেমীরা জানেন টারান্টিনোর সিনেমায় এই বিষয়টি খুব কমন (আমেরিকানিজমকে আক্রমণ করাটাও)।   তেমনি তিনি আরেক মাস্টার আলফ্রেড হিচকককে একেবারে হিচককীয় স্টাইলেই স্মরণ করেন। ধনী গৃহকর্তা যখন গোসল করছিলেন, সে সময় বাথরুমে তার বইয়ের তাকে একটা বই ফোকাস করা হয় যেটির প্রচ্ছদের ছবিতে ছিলেন হিচকক। মাস্টার অফ সাসপেন্সের প্রতিটি সিনেমার মতো বং নিজের সিনেমাতেও হিচককের ক্যামিও প্রেজেন্স বজায় রাখেন।
মন্তাজের দারুণ উদাহরণ দেখা যায় যখন পরিবারটি কিছু টাকার মুখ দেখে পিজা শপে যায়। সেই পিজা শপ, যাদের জন্য ওরা কাগজের প্যাকেট বানাত। যখন ওদের টাকা ছিল না, সেইসময় সেই পিজা শপের মেয়েটি ওদের সঙ্গে খুব চোটপাট করে। কিন্তু এবার সেই মেয়েটিকেই ওরা পাত্তাই দেয় না।   এই যে, একই শ্রেণির মানুষের মধ্যে ওপর-নিচের দ্বন্দ্ব এইটার আল্টিমেট রূপ দেখা যায় প্যারাসাইট দম্পতি আর দরিদ্র পরিবারটির প্রথম দেখায়। সেখানে ক্ষণে ক্ষণে উভয়ের অবস্থান পাল্টায় আর কুস্তি লড়াইয়ের মতো ওপরে উঠে নিচের মানুষটিকে মারার একাধিক দৃশ্য দেখা যায়। এইখানে পরিচালক গ্রামসির মতো করে দেখান, কীভাবে নিষ্পেষিত হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র শ্রেণি পরস্পরের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়। এই দৃশ্যে দুই কোরিয়ার লড়াইয়ের উল্লেখ, এই নিয়ে দারুণ বিদ্রুপ করাটাও সেই একই চিন্তার প্রতিফলন।

গ্রামসির, মার্ক্সের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত আধুনিক অর্থনীতিবিদ গাই স্ট্যান্ডিং। তার ‘প্রিক্যারিয়েট’ একটি মাস্টারপিস বই। এখানে তিনি এমন এক শ্রেণির উল্লেখ করেন, যারা প্রথাগত শ্রমিক শ্রেণির মতো নির্দিষ্ট শ্রেণি পরিচয় বহন করে না, বরং এদের কাজের নিশ্চয়তা নেই, সামাজিক অবস্থানেরও নিশ্চয়তা নেই।   খরচ কমানোর জন্য পুঁজিবাদ দিনকে দিন মানুষ আর প্রকৃতিকে রিডানডেন্ট করে ফেলার যে পাঁয়তারা করছে সেটির ভয়াবহ শিকার এই গোষ্ঠী। এর এক উদাহরণ দেখা যায় স্টার্টআপ করতে গিয়ে ধরা খেয়ে প্যারাসাইটের জীবন কাটানো লোকটি কিংবা সেরকম একটি স্টার্টআপে একসময় চাকরি করা দরিদ্র পরিবারের পিতাটির চাকরি হারানোর পর অনিশ্চিত জীবন কাটানোয়। তবুও, সেই প্যারাসাইট লোকটি প্রতিদিন তার খাবার জোগানো লোকটির উদ্দেশ্যে কুর্নিশ ছুড়ে দেন। সব হারিয়েও আবার আশা করেন। কিন্তু পরিচালক এতটা রোমান্টিক নন যে তিনি এই আশাকে বাস্তব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখেন। তাই, দরিদ্র পরিবারের পিতা খুন করে যখন প্যারাসাইটের জীবন বেছে নেয় তখন ক্ষণিকের জন্য মনে হয় তার পুত্র অনেক টাকা কামিয়ে তাকে একদিন মুক্ত করবে। কিন্তু, এরপরে বাস্তববাদী পরিচালক এই বার্তা দেন যে, ঐ বাড়িটি কিনতে ঐ যুবকের ৫৬৪ বছর টাকা জমানো লাগবে। অর্থাৎ, আশা আর রোমান্টিকতা যতই থাক, বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিচুতলার মানুষদের কখনোই উঁচুতলায় ওঠা হয়ে উঠবে না।

এই সিনেমায় আরও প্রচুর লেয়ার, প্রচুর মেটাফোরের উদাহরণ টানা যায়, সুক্ষè সব আলাপ আনা যায়, বিদগ্ধ দর্শক সেগুলো ভালোভাবেই দেখেছেন নিশ্চিত। তবে, শেষ করব সিনেমাটিক কিছু এক্সেলেন্সের উদাহরণ দিয়ে। চরম সুখের মুহূর্তে দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি মাতাল হয়ে ডগফুড খাচ্ছিল। বাইবেলে আমরা দেখি সম্রাট নেবুচাদনেজার চরম ক্ষমতার দম্ভে উল্টোপাল্টা জিনিস খাচ্ছিলেন বলে তিনি অভিশপ্ত হন।   মেয়েটিরও এরপর তাই হয়। পানিতে ভাসিয়ে নেওয়া উপশহরটির সেট ডিজাইন অসাধারণ। এডিটিংয়ে আছে কিছু জাদু। বহু শটের মন্তাজ তো আছেই, আছে নিয়মিত শট জোড়া লাগানো, জায়গামতো পরিমিত ফ্রিজ, ক্লোজআপ শট, দারুণ কার্যকর লং শট (সিঁড়ি দিয়ে নামা, পাহাড়ের ওপর থেকে বাড়ির দিকে তাকানো) এত এত গভীর মিনিং, ফিলোসফির সঙ্গে নিখুঁত টেকনিক্যাল শোকেস। এইরকম একটা অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য আপনাকে স্যালুট বং জুন হো।
লেখক
ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনুবাদক
faiz@dhaka.net


0 comments:

Post a Comment